...আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম___ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ...

বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব

 

বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব বলতে বিখ্যাত পাঁচজন বিখ্যাত কবিকে আখ্যায়িত করা হয়। বিশিষ্ট পাঁচজন কবি যারা রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষার আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তাদেরকে ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব বলা হয়। তারা হলেনঃ- ১. জীবনানন্দ দাশ, ২. বুদ্ধদেব বসু, ৩. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ৪.বিষ্ণু দে, ৫. অমিয় চক্রবর্তী।

অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬)
আধুনিক কবিদের মধ্যে সর্বাধিক জটিল এবং দ্বিধাবিভক্ত কবি মানসের অধিকারী। তিনি রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিগত সচিব ছিলেন। তথাপি রবীন্দ্র প্রতিভা বিরোধী।
তার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ: ‘খসড়া’, ‘এক মুঠো’, ‘মাটির গান’, ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’, ‘দূরবাণী’, ‘পারাপার’, ‘পালাবদল’, ‘ঘরে ফেরার দিন’, ‘হারানো অর্কিড’, ‘পুষ্পিত ইমেজ’, ‘অনিঃশেষ’ প্রভৃতি।
অমিয় চক্রবর্তী দেখিয়েছেন উপমা ছাড়াও কবিতা হয়। তাঁর কবিতার ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের কৌশল, পঙক্তি গঠনের নিয়ম বাঙালি কবিদের মধ্যে অনন্য সাধারণ। সংস্কৃত শব্দ তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে। কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সাথে সাথে অবচেতনার যে সদৃশ আছে তা তিনি দেখিয়েছেন সুনিপুণতায়। বুদ্ধদেব বসু অসংকোচে অমিয় চক্রবর্তীকে বলতেন ‘কবির কবি’। কবি আল মাহমুদ অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছেন, ‘ঋণগ্রস্ত না করে করেছিলেন বিস্মিত ও অভিভূত।
তার মিল ও পঙক্তি বিন্যাসের অনভ্যস্ত প্রয়োগ আমার কাছে কিছু দিন অত্যন্ত লোভনীয় মনে হলেও এর দুরূহতা শেষ পর্যন্ত আমাকে নিশ্চেষ্ট না করে ছাড়ে নি। এমন কী পয়ারের কারুকাজেও।’ আবদুল মান্নান সৈয়দও অমিয় চক্রবর্তীর সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাঁর কবিতা একেবারেই অন্যরকম। কোন পোগান বা চিৎকৃত বাক্যের থেকে অনেক দূরে: মননাশ্রিত, অ্যাবস্ট্রাক্ট অথচ মমতার ঘন নিবিড়।’ তাঁর কবিতার ভিতরে আবেগের সঙ্গে মিশে আছে মননশীলতা। প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে প্রবল সময় ও সমাজ-সচেতনতা। তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য বেশি পেলেও তাঁর কবিতা ছিল সম্পূর্ণ রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত। এই জন্যই তাকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎ পঞ্চপাণ্ডবদের একজন ধরা হয়।

বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২)
মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি বিষ্ণু দে ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নব্যধারার আন্দোলনের প্রধান পাঁচজন কবির অন্যতম ছিলেন। বিষ্ণু দে, জীবনের কোন এক সময়ে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার প্রবাহিত ধারার মধ্যে দিয়েও সময় কাটিয়েছেন; যা আমরা দেখতে পাই তাঁর রচিত বেশ কিছু কবিতায়।
রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতি সচেতনতা; বাংলাদেশের লৌকিক যাপিত জীবনচর্চার প্রতি অনুরাগ, গভীর অনুভূতি প্রিয়, পুরাণ এবং ইতিহাস জাগ্রতবোধ, ছন্দের সুচারু সার্থক ব্যবহার, বিচিত্র বিন্যাসে কবিতায় মিলের চমক, শব্দ প্রয়োগের নৈপুণ্য এবং সর্বোপরি এক বিরাট বিশ্ব ও মানবিকবোধে নিমগ্ন আধুনিক কবি বিষ্ণু দে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন প্রথম জীবনে।
এছাড়া তিনি কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিরিশের প্রধান কবিদের একটি দিক খুব স্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয়; আর তা হলো তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ এবং নিজস্বতার পরিচয়। যে দৃষ্টিকোণ আর নিজস্বতা থেকে বাদ যাননি বিষ্ণু দে-ও। কখনো সেটাই দেখা দিয়েছে কবিতার শব্দের রুচির ব্যাপার হ’য়ে। বিষ্ণু দে ব্যক্তিগত শোক, দুঃখ, অনুতাপ, আবেগ আর অনুশোচনাকে নিয়ে আসেননি তাঁর কবিতায়। কিন্তু তাঁর কবিতা থেকে গেছে ভাষা সংহত এক কবিতা হয়ে; যা হয়ে উঠেছে এক বিশুদ্ধ কবিতা রূপে। যে ভাষা তিনি নির্বাচন করেছেন তা হয়ে উঠেছে একান্তভাবে বিষ্ণু দের ভাষা ; যে ভাষা প্রসারিত রূপ পেয়েছে তাঁর-ই কবিতায়।
অনুবাদ : ‘এলিয়টের কবিতা’।
১৯২৩ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশের ফলে জন্ম নেয়া সাহিত্য গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য।
প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘উর্বশী ও অার্টেমিস’, ‘চোরাবালি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ’, ‘সেই অন্ধকারে চাই’, ‘ইতিহাসের ট্রাজিক উল্লাসে’, ‘রবিকরোজ্জল নিজদেশে’, ‘দিবানিশি’, ‘চিত্ররূপমত্ত পৃথিবী’, ‘উত্তরে থাকা মৌন’, ‘ আমার হৃদয়ে বাঁচো’, ‘পূর্বমেঘ’, ‘সন্দীপের চর’, ‘অনিষ্ট’, ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১ – ১৯৬১)
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অন্যতম একজন। তিনি বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, কবিতাকে করেছে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। নিচে তার পরিচয় ও কবিতায় অবদানের কথা উল্লেখ করা হলো :
কবিতা গ্রন্থ: ‘তন্বী’, ‘অর্কেষ্ট্রা’, ‘ক্রন্দসী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সংবর্ত’, ‘প্রতিদিন’, ‘দশমী’।
ইউরোপীয় বিভিন্ন কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ- ‘প্রতিধ্বনি’।১৯৩১ সালে তিনি ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন।সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতে জর্জরিত। তিনি আপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে নতুনত্বের সন্ধানী। বাংলা কাব্যে তিনি নৈরাশ্যবাদের আত্মার সন্তান। সুধীন দত্ত জড়বাদী ও ক্ষণবাদী দর্শনের অভিব্যক্তির অন্তরালে আধুনিক দার্ঢ্য, অভিজাত কাব্যভাষার উদ্ভাবক। স্বদেশ-বিদেশের কোনো কোনো কবির সঙ্গে কাব্য নির্মাণে ও কাব্যভাষায় সংযুক্ত হলেও তিনি সেসব কবির আপাত ও লুকানো প্রভাব ছাড়িয়ে আপন মৌলিকতাকে করেছেন সুস্পষ্ট। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র, একাকী ও উত্তর সাধকের বিস্ময়স্থল।

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। তিনি বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, কবিতাকে করেছে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।
জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ (বরিশাল)
উপাধি: ধূসরতার কবি, তিমির হননের কবি, নির্জনতার কবি, রূপসী বাংলার কবি, প্রকৃতির কবি (বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক অভিহিত), পরা বাস্তবতার কবি, বিপন্ন মানবতার নীলকণ্ঠ কবি।
কাব্যগ্রন্থ : ‘মহাপৃথিবী’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘বনলতা সেন’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘ঝরা পালক’, ‘ধুসর পান্ডুলিপি’।
তাঁর সাহিত্যে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় প্রকৃতি। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বাংলা কবিতায় উত্তর আধুনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। প্রকৃতি আর প্রেম তাঁর কবিতায় অসাধারণ রূপকল্পনাময় অভিব্যক্তি পেয়েছে। স্বদেশ, সমাজ-সমকাল, নির্জনতা, মুগ্ধতা, একাকিত্ব কবিতার প্রধান উপজীব্য। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে তিনি কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন।
আধুনিক বাংলা কবিতা’র ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার চারিত্র্যলক্ষণ আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’ জীবনানন্দ দাশ সেই কবি যাঁর কবিতায় এসব অনুষঙ্গের সন্ধান মেলে সময়ের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে।
তার এই সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যেকে এক নতুন দিশায় নিয়ে এসেছে। তার কবিতায় আধুনিকতা ফুটে উঠেছে খুব গুরুত্বের সহিত। ফলে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের অবদান অনস্বীকার্য।
মৃত্যু: মহান এই কবি ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ (কলকাতায় ড্রামের নিচে পড়ে আহত হন এবং হাসপাতালে মারা যান।)

বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ -১৯৭৮)
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবি ও কবিতার আলোচনায় বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) নাম অবধারিতভাবেই এসে যায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্যবিস্তারকে পাশ কাটিয়ে বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র সরণি নির্মাণের যে প্রয়াস তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে লক্ষ করা যায়।
বুদ্ধদেব বসু সেই সরণি নির্মাণের অন্যতম কারিগর।
কেবল অভিনব কবিতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর প্রয়াস সীমাবদ্ধ রাখেননি। আন্তর্জাতিক কাব্যপ্রবাহের সঙ্গে বাংলা কবিতার সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াস উত্তর-প্রজন্মের কবি সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে কলোনিয়াল সমাজের নগর-মানুষের পরিপার্শ্ব – হতাশা, বিপন্নতা, আশা-স্বপ্নকে নিজের কল্পনামুগ্ধতা দিয়ে সবার করে তুলতে পেরেছিলেন।
বিখ্যাত “কবিতা” তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা।
১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ লাভ করেন।
কাব্যগ্রন্থ: ‘মর্মবাণী’, ‘বন্দীর বন্দনা’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘কঙ্কাবতী’, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’, ‘একদিন চিরদিন’।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url